আত্মোন্নয়ন || জন সি ম্যাক্সওয়েল


যখনই আমি কোথাও বক্তৃতা দিতে যাই, সাধারনত বক্তৃতা শেষে আমি মানুষের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠি, তাদের সাথে করমর্দন করি আর বইয়ে অটোগ্রাফ দেই। প্রায়ই এসব ক্ষেত্রে হয়তো আমাকে কেউ একজন এসে বলে, “ইশ্‌ যদি আপনার সাথে পুরো একটা দিন কাটাতে পারতাম।”
একথা শুনে আমি মনে মনে হাসি। কারণ আমার অতিবাহিত দিনগুলি অনেকটাই নিষ্প্রভ।
হ্যা, একঝাক শ্রোতার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করা অনেক রোমাঞ্চকর। এবং মানুষের সাথে দেখা করতে, তাদেরকে সাহায্য করতে সত্যিই ভালবাসি আমি। কিন্তু আমার জীবনের অধিকাংশ সময়টা বাঁধা-ধরা রুটিনে আর সুস্থিত শৃংখলা দিয়ে তৈরী।
আপনার প্রতিদিনকার রুটিন নির্ধারণে প্রথম ধাপ হল আপনার সবচে’ গুরুত্বের কাজটি চিন্তা করে বের করতে পারা। আপনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে পারবেন না যদিনা আপনি আপনার অগ্রাধিকার কোনটি সেটা বুঝতে পারেন।
যদি আপনি আপনার নিত্যদিনের মূলমন্ত্রগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে থাকেন, তাহলে আমার নিচে দেওয়া অঙ্গীকারনামা গুলো দিয়ে শুরু করতে পারেন।
১. আচরণভঙ্গিঃ সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আমি প্রতিদিন দেখাবো।
২. অগ্রাধিকারঃ আমার সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পন্ন করব আমি প্রতিদিন।
৩. স্বাস্থ্যঃ প্রতিদিন সুস্বাস্থ্যের মূলনীতি মেনে চলব।
৪.পরিবারঃ প্রতিদিন পরিবারের প্রিয় মানুষগুলির খেয়াল রাখব ও তাদের সাথে যোগাযোগ করব আমি।
৫. চিন্তাঃ প্রতিদিন আমি ভাল চিন্তা করব।
৬. প্রতিশ্রুতিঃ প্রতিদিন আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করব।
৭.টাকা-পয়সাঃ প্রতিদিন যথাযথভাবে হিসেব করে টাকা-পয়সা ব্যয় করব আমি।
৮.ধর্মীয় মূল্যবোধঃ প্রতিদিন আমার ধর্মীয়বিশ্বাসকে আরো গাঢ় করব ও ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করব।
৯. সম্পর্কঃ প্রতিদিন আমি দৃঢ় সম্পর্কের সূচনা ও বিনিয়োগ করব।
১০. দাক্ষিণ্যঃ প্রতিদিন আমি অনুকরণীয় উদারতার চর্চা করব।
১১.মূল্যবোধঃ প্রতিদিন উন্নত মান আকড়ে থাকব।
১২. বিকাশঃ প্রতিদিন নিজের বৃদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করব।
উপরোক্ত মূলমন্ত্রগুলোকে ভিত্তি করে কিভাবে আমি আমার একটা গড়পড়তা দিন পাড় করি সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আপনাদেরকে নিয়ে যাব। একই সাথে আপনাদের দিনগুলোকে কিভাবে ফলপ্রসূ করে সাজানো যায় সেটাও শিখাবো।
আগের রাতেই প্রস্তুত হৌন
আমার দিনকে সফল করে তুলতে আমাকে তা পূর্ব রাতে শুরু করতে হয়! ঘুমাতে যাবার আগে আমি দুটো জিনিষ করি। প্রথমত, আমি যে দিনটি শেষ করছি তার দিকে তাকাই। আপনি অনাগত দিনটিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারবেন না যদিনা বিগত দিনটির কাজের মূল্যায়ন করেন। আজকে কাকে সাহায্য করলাম? কীই বা শিখলাম আজ? সেরাটা কি দিতে পেরেছি?
দ্বিতীয়ত, আগামী দিন আমাকে কি কাজ শেষ করতে হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করি। জানি, দিনের সব কটা মূহুর্তে আমি আমার হার না মানা মনোভাব চাঙ্গা রাখতে পারব না। তাই আমার কাজের তালিকা আর সময় সূচির দিকে তাকাই। মূল কাজ কোনটা হবে সেটা নির্ধারণ করি। নিশ্চিত করি যে, সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে নিজের শতভাগ দিতে পারব।
সারাজীবনের কাজকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজানোর চেষ্টা করবেন না। শুধু দিনটিকে অগ্রাধিকারের ক্রমে সাজান। যদি চার, আট কিংবা ১২ ঘন্টার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন, আপনার সফল হওয়া সম্ভব।
সকালবেলা সঠিক প্রশ্নটি করুন
যেহেতু কি করতে হবে তা জেনেই ঘুম থেকে উঠি, সেহেতু একটা চটপটে শুরু করতে পারি। এর কারণে শুধু মাত্র একটা প্রশ্নই আমাকে সকালে চিন্তা করতে হয়ঃ কিভাবে আজ আমি মানুষের জীবনকে আরো মূল্য যোগ করতে পারি?
এই প্রশ্নটি করার কারণে, আমার দায়িত্বসমূহ পালনের অনুকূল মানষিক অবস্থা তৈরী হয়। আমি দুনিয়ায় পরিবর্তন আনতে চাই। প্রতিদিন আমি যাদের সম্মুখীন হচ্ছি তাদের জীবনে যখন অর্থ যোগ করতে সক্ষম হই, দিনটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি ভেবে তখন কিছুটা সন্তুষ্টি লাভ করি।
নিজের সেরাটা দিন
দিনের কিয়দাংশ আমার ছকে বাঁধা। পূর্বরাতে আমি আমার করণীয় ঠিক করে নেই। সকালে মানষিক অবস্থান ঠিক করে নেই। কষ্ট করে বিকেলে অথবা ভোরে রাস্তায় ঘোরার সময় শরীর চর্চার সময় বের করি। এবং নিজের বৃদ্ধি ঘটবে এমন কাজ করার সময় রাখি।
দিনের বাকি সময়টা ছকে বাঁধা নয়। কখনোবা উপস্থিত শ্রোতামন্ডলীর উদ্দেশ্যে আমি বক্তৃতা করছি, কখনোবা, আমার টীমের নেতাদের সাথে বৈঠক করছি। নাহয় লিখছি, নাহয় ভবিষ্যত প্রোজেক্ট নিয়ে চিন্তা করছি, নাহয় রেকর্ডিং এর কাজ করছি।
দিনে যে কাজটাই করতে হয় না কেন, নিজের শতভাগ দিতে চেষ্টা করি। প্রতিমুহূর্তে সেরাটা দিতে পারলেই জীবনে সফলতা পাওয়া যায়, নেতৃত্ব অর্জন করা যায়। মানষিক, শারীরীক, আধ্যাত্মিক ও আবেগীয় ভাবে যদি নির্দিষ্ট মুহূর্তকে উপভোগ করতে পারেন তাহলে আপনি আপনার শতভাগ দিতে পারবেন। এবং এই শতভাগ বিলিয়ে দেওয়া মানুষগুলোই শিখরে উঠতে পারে, দুনিয়ার পরিবর্তন করতে পারে।
বিল ক্লিন্টন ছিলেন আমার দেখা সবচে’ বেশী “শতভাগ” ঢেলে দেওয়া মানুষ। তার দ্বিতীয় টার্মে একবার হোয়াইট হাউজে তার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয় আমার। যে অল্প কিছু মুহূর্ত তার সাথে আমি কাটিয়েছিলাম, তার সবটুকু জুড়েই তিনি আমাদের কথোপকথনে শতভাগ মননিবেশ করে ছিলেন। নিজেকে সে সময় আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল!
শিখতে থাকুন
যা যা বলেছি তার সব যদি করতে পারেন তাহলে একজন সফল ব্যক্তি হিসেবে মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারবেন। কিন্তু এই সাফল্য কতদিন টিকিয়ে রাখবেন? প্রতিদিন নিজেকে সমৃদ্ব করতে হবে আপনাকে। তাহলেই পারবেন।
পাচটি কাজ আমি প্রতিদিন করি যেগুলোকে আমি “পাঁচটি নিয়ম” নাম দিয়েছি। যার মাধ্যমে নিজের বিকাশ চলমান রাখিঃ
১. পড়িঃ সবসময়ই আমি আমার মনের খোড়াক জুগিয়ে চলেছি। সপ্তাহে একটা কি দুটো বই পড়ে ফেলার চেষ্টা করি। কিছু বইয়ের শুধু সারটা পড়ি (skim). বাকিগুলোর পুরোটুকুই গিলি। অডিও ম্যাসেজ বা পডকাস্টও শুনি। এগুলোর সেরাটা বাঁচাই করে আমি প্রতিলিপি তৈরী করি।
২. জিনিষপত্র সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখিঃ হারানো জিনিষ খুজতেই লোকেদের সবচে’ বেশী সময় নষ্ট হয়। তাই শুধু পড়লেই হবে না। যখনই আমি ভাল উক্তি বা আইডিয়া পেয়ে যাই, তখনই তা সাজিয়ে গুছিয়ে ( সুবিন্যস্ত করে) টুকে রেখে দেই। আর সেকারণেই মিনিটের মধ্যেই যেকোন জিনিষ খুঁজে বের করতে পারি।
৩. লিখিঃ অন্যদেরকে প্রধানত আমি আমার লেখা আর বক্তৃতার মাধ্যমেই সাহায্য করে থাকি। যার কারণে, আমাকে নিয়মিতই লেখালেখি করতে হয়। আমার ব্রীফকেসে অথবা ডেস্কে আপনি সবসময় আমার লেখার কাজে লাগছে এমন ফাইল বা উপকরণ খুজে পাবেন।
৪.চিন্তা করিঃ মনেহয় দিনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা করি সেটা হল কাজ থামিয়ে শুধুই চিন্তাভাবনা করা। এ সময়ে আমার অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করি, বিভিন্ন সুযোগের সম্ভাব্যতা পরিমাপ করি, কিভাবে আমার টীমকে সাহায্য করতে পারি তা নিয়ে ভাবি। আর খোদার কাছে পথনির্দেশ চাই।
৫. প্রশ্ন করিঃ ভাল প্রশ্ন করতে পারলে সোভাগ্যের দরজা খুলে যায়। আর কাজের নানা সুযোগ আমাদের চোখে ধরা পড়ে।  “Good Leaders Ask Great Questions” 
পুনর্প্রস্তুতি শুরু করুন
দিনের শেষে আমি আবার একই প্রক্রিয়া পুনরায় আরম্ভ করি। আবার আমি আগামীকালের পরিকল্পনা করি আর আজকের দিনের কাজগুলোকে মূল্যায়ন করি। যদি আজকে আমি কারো জীবনে মূল্য (value) যোগ করতে সক্ষম হয়ে থাকি তাহলে আমার পরিবার, কমিউনিটি আর দেশের আরো উন্নতির জন্য আমি কিছু করতে সক্ষম হয়েছি বলব। মিশন সফল আমার!

John C. Maxwell



No comments

Powered by Blogger.